প্রথম ক্যামেরাদের আজব গল্প
প্রথম ক্যামেরাদের আজব গল্প
কিছু ইতিহাস … দৈনন্দিন জীবনে রসায়ন পদার্থবিদ্যার কিছু বিস্ময় প্রযুক্তি বিজ্ঞান বিজ্ঞানের খবর
অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়MathWorks
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসী লুই ড্যাগের ছবি তোলার এক আশ্চর্য পদ্ধতি বার করেছিলেন। নিজের নাম দিয়ে ড্যাগেরোটাইপ বলে একধরণের বিশেষভাবে তৈরী প্লেট চালু করেছিলেন তিনি। ওনার দাবি ছিল, ওই প্লেট-এ উনি সামনের দৃশ্য বন্দী করতে পারবেন। অনেকে এই ড্যাগেরোটাইপ-কেই ফটোগ্রাফি-র যাত্রাশুরু বলে ভেবে থাকেন। কিন্তু এই ড্যাগেরোটাইপ-এ কিভাবে একটা ছবি ধরা পড়ে, সেই প্রশ্নের সবটা কিন্তু এখনো জানা যায়নি। একদল বিজ্ঞানী নামলেন না-জানা উত্তরগুলো খুঁজতে।এই ইতিহাসের সুতো গোটাতে গোটাতে পিছিয়ে গেলে এক সময় আসবে ড্যাগেরোটাইপ। ফরাসী আর্টিস্ট লুই ড্যাগের (Louis Daguerre)-এর সৃষ্ট এক অভিনব পদ্ধতিতে একটা প্লেট-এর ওপর ম্যাজিকের মতো একটা ছবি বন্দী হয়ে যেত। সেই ড্যাগেরোটাইপ নতুন করে আজকের বৈজ্ঞানিকদের উৎসাহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কি এই ড্যাগেরোটাইপ? সেই গল্পে যেতে হলে আগে “ছবি তোলা” জিনিসটাকে একটু কাটাছেঁড়া করতে হবে। একটা ছবি তোলার পিছনে দুটো ঘটনা কাজ করে। যার ছবি তুলছি, তার থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে একটা পর্দার ওপর পড়বে (কিছু ক্ষেত্রে বস্তুটা থেকেই আলো আসতে পারে, যেমন প্রদীপের শিখা)। সামনের বস্তু থেকে প্রতিফলিত আলো গিয়েই পড়বে, চারিপাশের অন্যান্য আলো সেখানে ঢুকতে পাবে না। দ্বিতীয়ত, আলো-টা সেই পর্দার ওপর একটা স্থায়ী ছাপ ফেলে যাবে।
ড্যাগেরোটাইপ-এর পূর্বসূরি: ক্যামেরা অবসকিউরা
প্রথম সমস্যাটার সমাধান অপেক্ষাকৃত সহজ। একটা বাক্সে আলপিন-সাইজের একটা ফুটো করে দৃশ্যের দিকে সেই বাক্সটাকে তাক করলেই হলো। আলো যেহেতু সোজা পথে যায়, সামনের দৃশ্য থেকে প্রতিফলিত আলো বাক্সের ফুটো দিয়ে ঢুকে উল্টো দিকে অর্থাৎ বাক্সের পিছনের দেয়ালে সেই দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করবে। সেই প্রতিচ্ছবি অবিকল সামনের দৃশ্যের মতোই হবে, খালি উল্টে দেওয়া। অর্থাৎ মাথা নিচে, পা উপরে। নিচের ছবিতে দেখো এটা কিভাবে সম্ভব। এই ক্যামেরার সাফল্যের জন্য পারিপার্শ্বিক আলোকে যতটা সম্ভব ঢুকতে না দেওয়া যায় ভালো কারণ সেই আলো বাক্সের দুধারের দেয়ালে প্রতিফলিত হয়ে পিছনের দেয়ালের ছবিটা ঘেঁটে দিতে পারে। যেমন, পারিপার্শ্বিক আলো আটকাতে একটা কাপড়ের ছাউনি দেওয়া যায় বাক্সটার ওপর, অবশ্যই ফুটোটাকে না আটকে।
একে বলে পিনহোল ক্যামেরা (pinhole camera) বা ক্যামেরা অবসকিউরা (camera obscura)। শুধু এটুকু হলে আমরা প্রথাগতভাবে যাকে ক্যামেরা বলে বুঝি, সেইটা হবে না কারণ এতে ছবির কোনো স্থায়িত্ত্ব নেই। কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যবহার করা হতো স্রেফ ছবি আঁকার শর্টকাট পদ্ধতি হিসেবে। এই ছবি আঁকাকে প্রায় চিটিং বলা যেতে পারে। চোখে দেখে ছবি না এঁকে ক্যামেরা অবসকিউরা-র পর্দায় যে ছবি পড়ছে, তার ওপর ছবি পড়াকালীন পেন্সিল বুলিয়ে নেওয়া যায়। অর্থাৎ ক্যামেরা-টা এক্ষেত্রে হবে একটা মানুষ সাইজের ঢাউস বাক্স, একটা ঘরই বলা যায়। সেই ঘরে আর্টিস্ট-মশাই ঘাপটি মেরে বসে থাকবেন। যেই ঘরের দেয়ালের ফুটো দিয়ে উল্টোদিকের দেয়ালে ছবি পড়বে, আর্টিস্ট তার ওপর পেন্সিল বুলিয়ে নেবেন। ব্যাস, সামনের দৃশ্য হটিয়ে নিলেও ছবি পাকাপাকিভাবে রয়ে গেল দেয়ালে।
এখানেই লুই ড্যাগের ও তাঁর কিছু অগ্রজদের কেরামতি। তাঁরা ওই আর্টিস্ট-কে নিষ্প্রয়োজন করে দিলেন। এমন এক প্লেট বানালেন যাতে সরাসরি সামনের দৃশ্য স্থায়ীভাবে বন্দী হয়ে যাবে। এটাই ড্যাগেরোটাইপ।
ছবি আসলে রাসায়নিক বিক্রিয়া
ভালো ড্যাগেরোটাইপ তৈরী করাটা সেইসময় রীতিমতো দক্ষতার ব্যাপার ছিল। ম্যানুয়াল পড়ে প্লেট বানালেও যেমনটি চাই, সেরকম স্পষ্ট ছবি আসবে, তার গ্যারান্টি ছিল না। তবে পদ্ধতি একটা নথিবদ্ধ আছে। প্রথমে তামার প্লেটে রুপোর একটা স্তর পড়বে, সেটা আয়োডিন গ্যাস-এর সংস্পর্শে এসে সিলভার আয়োডাইড তৈরী করবে।
এই সিলভার আয়োডাইড স্তরটাই যাকে বলে ফটোসেনসিটিভ স্তর। আলো পড়লে সিলভার আয়োডাইড কিছুটা ভেঙ্গে যায় এবং গুটলি গুটলি রুপো পড়ে থাকে। যে আলোটা পড়লো, এই বিক্রিয়ার মাধ্যমে ছাপ রেখে যায় প্লেটের ওপর (আরো বিশদে পরে আসছি)। এবার এই আলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে শুধু সামনের দৃশ্য থেকে প্রতিফলিত আলোই পড়ে প্লেটের ওপর। কিন্তু আলো নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি আমরা আগেই দেখেছি: ক্যামেরা অবসকিউরা-র বাক্সটা। সেই বাক্সে ফুটোর উল্টোদিকের পর্দায় ওই প্লেট-টা বসিয়ে দিলেই হলো।
এইভাবে ড্যাগেরোটাইপ প্লেটটা ক্যামেরা-র বাক্সে বসে সামনের দৃশ্যকে ধরাশায়ী করে ফেলে। একে বলে এক্সপোজ করা। অর্থাৎ প্রয়োজনমতো প্রতিফলিত আলো ড্যাগেরোটাইপ প্লেট-এ গিয়ে পড়লো। এক্সপোজ করার পর ক্যামেরা-র ফুটো বন্ধ করে একটা অন্ধকার ঘরে এনে প্লেটটাকে বার করা হয়। সেই প্লেট-এ কিন্তু তখনও কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এবার প্লেটটাকে গ্যাসীয় অবস্থায় মার্কারি বা পারদের সংস্পর্শে আনা হয়। রুপোর গুটলিগুলোর ওপর গ্যাসীয় অবস্থার পারদ গিয়ে জাঁকিয়ে বসে সলিড হয় এবং রুপো-পারদ মিশ্রণ তৈরী করে। এবার ছবিটা স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় প্লেট-এর ওপর।
বাকি কাজগুলো করা যাতে ছবিটা আর এক্সপোজ না হয়। অর্থাৎ, নতুন করে আলো পড়লেও আর কোনোরকম রাসায়নিক বিক্রিয়া না হয়। প্লেটটাকে সোডিয়াম থায়োসালফেট দ্রবণে চোবানো হয় যাতে পড়ে থাকা সিলভার আয়োডাইড ধুয়ে যায়। এটাকে বলে ফিক্সিং। ছবিটাকে পাকাপাকিভাবে প্লেটে বন্দী করা হলো। সবশেষে একটা সোনার পুরু স্তর বসানো হয় যাতে ছবিটা আরো স্পষ্ট দেখা যায়, আরো দীর্ঘস্থায়ী থাকে।
শেষের ছবিতে ঠিক কি রইলো
এতো সব কাণ্ডের পর ছবির প্লেটে যেটা পড়ে থাকে, সেটা হলো হরেক সাইজের, হরেক আকারের রুপো-পারদ ন্যানোমিটার-সাইজ দানা। কিছু
এটা কিভাবে হলো? সেই গবেষণা করার রসদ ঊনবিংশ শতাব্দীতে ছিলনা। আলো পড়ে একটা বিক্রিয়া হলো, সেই বিক্রিয়ার অবশিষ্টকে পাকাপাকিভাবে সেট করে দিলে, এই নতুন ছবিতে আলো পড়লে আগের দৃশ্যটা চোখে ধরা দেয়, এটুকু জানাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এখন সেই গবেষণা সম্ভব। মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অফ আর্ট-এর সহযোগে কিছু বিজ্ঞানী সেই গবেষণা করলেন [২]।
সে গবেষণার উদ্দেশ্য শুধু এককালের ক্যামেরার রহস্যভেদ নয়, তার আধুনিক কিছু প্রয়োগও রয়েছে। মোদ্দা সমস্যা হলো এইটা বার করা: একটা ধাতুর এবড়োখেবড়ো উপরিতল, যেখানে উঁচুনিচুগুলো ন্যানোমিটার সাইজের, তাতে আলো এসে পড়লে সেই আলো কিভাবে ছড়িয়ে পড়বে। ছড়িয়ে পড়া আলোর মধ্যে কোনদিকে নীল বেশি থাকবে, আর কোনদিকে লাল, এইরকম সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেরিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা।
No comments