দেওয়ালে পিঠ ইলেকট্রনিক্সের - আলোয় চলবে নতুন যুগের কম্পিউটার? - প্রথম পর্ব
দেওয়ালে পিঠ ইলেকট্রনিক্সের - আলোয় চলবে নতুন যুগের কম্পিউটার? - প্রথম পর্ব
পদার্থবিদ্যার কিছু বিস্ময় প্রযুক্তি বিজ্ঞান
রক্তিম হালদারLeibniz University
ষাটের দশকে ইন্টেল-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মূর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে প্রত্যেক দুবছরে ইলেকট্রনিক সার্কিট-এ ট্রানজিস্টর-এর ঘনত্ব দ্বিগুণ হতে থাকবে। অর্থাৎ, স্বল্প পরিসরে উত্তরোত্তর আরো জটিল সার্কিট ধরানো যাবে। সেই সার্কিট ছোটো হতে হতে এমন সাইজে পৌঁছে গেছে যে আরো কমাতে গেলে এখন তার স্পিড-এ কোপ পড়বে। প্রকৃতির এই সীমা মেনে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। অথচ বিশ্বজুড়ে এতো যে তথ্য সংগ্রহ এবং প্রসেসিং-এর খাঁই, তাকে পূরণ করতে হলে সার্কিটের ক্ষুদ্রায়ণ থামিয়ে দিলে চলবে না। এই সময়ে পরিত্রাতা হয়ে এলো ফোটোনিক্স। কীভাবে? সেই গল্প শুনুন এক আলোকপ্রযুক্তি গবেষকের কাছ থেকে।
তবে জানেন কি, এই ইলেকট্রনিক যন্ত্রগুলির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে হয়তো খুব শীঘ্রই বাজারে আসতে চলেছে নতুন প্রযুক্তি। আরও গতিশীল, কম্প্যাক্ট, হালকা, এবং সুলভ, কারণ ব্যাটারির খরচাও অনেক কম! হ্যাঁ, সেই প্রযুক্তির নাম ‘ফোটোনিক্স’। তবে তার আগে ভালো করে জেনে নেওয়া দরকার আজকের যুগের ইলেকট্রনিক টেকনোলজির ঘাটতিগুলো ঠিক কী কী এবং এর সমাধানই বা কী করে সম্ভব [১-৪]?
ইলেকট্রনিক যন্ত্র কাজ করে কীভাবে? এর ঘাটতিগুলো কী কী?
‘ইলেকট্রনিক্স’ বা ‘তড়িৎ-কণা বিদ্যা’ হলো পদার্থবিজ্ঞানের এমন একটি শাখা বা বিদ্যা যেখানে বিভিন্ন যন্ত্র বা যন্ত্রাংশের সাহায্যে উপযুক্ত মাধ্যমে কী করে তড়িৎ কিম্বা ইলেকট্রনের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে নিজের সুবিধা মতো কাজে লাগানো যায় তাই নিয়ে আলোচনা করা হয় [৫]। যন্ত্র বলতে গ্যাসটিউব, ট্রানজিস্টার, কিংবা মাইক্রোচিপ হতে পারে। তাতে মাধ্যম হতে পারে তড়িৎ পরিবাহী গ্যাস, সেমিকন্ডাক্টার/অর্ধপরিবাহী পদার্থ যেমন সিলিকন ইত্যাদি। ইলেকট্রনিক্সে অভূতপূর্ব পারদর্শিতার নিদর্শন আমাদের হাতের মুঠোয় বন্দি তন্বী স্মার্ট ফোনটি, বা ডেস্কের উপর রাখা ছিমছিমে গড়ন ল্যাপ্টপখানি।
কম্পিউটার চলে তড়িৎ শক্তিতে। সে আমাদের মতন সংবেদনশীল বা আবেগপ্রবণ নয়। সে বোঝে শুধু তার ‘মাদার বোর্ড’-এ থাকা ট্রানজিস্টরগুলোতে তড়িৎ-বিভব বা ভোল্টেজের ওঠানামা। যদি ভোল্টেজ কম দেওয়া হয় তবে ভাবে শূণ্য (০) আর বেশি দিলে (সাধারণত ৫ ভোল্ট) বোঝে এক (১)। যা কিছু কাজ, জটিল গাণিতিক হিসাব-নিকাশ, রকেট উৎক্ষেপণ থেকে গেম খেলা বা চ্যাট, সিনেমা দেখা, সবই হয় এই ‘০’ ও ‘১’ এর সমন্বয়ে অথবা কম্বিনেশনে। শুধু কম্পিউটার কেন, ইলেকট্রনিক্সের যে কোনো যন্ত্র, মোবাইল ফোন থেকে আজকের ডিজিটাল টেলিভিশন, সব এভাবেই কাজ করে। এই ‘০’ বা ‘১’ কে বলে এক একটি ‘বিট’। শুধুমাত্র দুটি সংখ্যা, ‘০’ এবং ‘১’ এর সমন্বয়ে তৈরি এ হেন গাণিতিক শাখাকে বলে ‘বাইনারি সিস্টেম’ যা ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স-এ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইলেকট্রনিক যন্ত্রগুলির মধ্যে থাকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র (প্রায়শই ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার থেকেও ছোটো [৬], মাত্র কয়েক ন্যানোমিটার (১০−৯) সাইজের) ‘সুইচ’ বা ট্রানজিস্টার যা অভ্যন্তরীন সার্কিটের মধ্যে তড়িৎ প্রবাহের পরিমাণ এবং অভিমুখকে আমাদের প্রয়োজনানুসারে নিয়ন্ত্রণ করে (চিত্র ১)। বাইরে থেকে কি-প্যাডের মাধ্যমে আমরা আসলে এই সুইচগুলোই চালু (অন্) বা বন্ধ (অফ্) করে সার্কিটের বিভব বা ভোল্টেজ নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। আজকের যুগের উন্নত কম্পিউটারে এরকম কয়েক কোটি সুইচ বা ট্রানজিস্টার বর্তমান, যেগুলোকে আমরা বাইরে থেকে প্রোগ্রামের সাহায্যে নিমেষের মধ্যে অন্ বা অফ্ করতে পারি। কম্পিউটারের স্পিড কত বেশি হবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে কত দ্রুত এই সুইচগুলো অফ্ বা অন্ করা যায়, এককথায় কম্পিউটারের ‘ক্লক-স্পিড’-এর উপর [৭]।
অতএব নিরন্তর প্রয়াস চলে কী করে এই কম্পিউটারগুলিকে আরও ছোটো, গতিশীল এবং সুদক্ষ করে তোলা যায়। সমস্যা এখানেই! ইলেকট্রনিক সার্কিটের মিনিয়েচারাইজেশন যেমন খুশি তেমন ভাবে করা সম্ভব না। কারণ, যখনই দুটি ইলেকট্রনিক সার্কিট একে অপরের খুব কাছে আসে, তখন এদের মধ্যে তড়িৎ-কণা বা চার্জ জমা করে রাখার ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যায়। চার্জ-ধারণ করার এই প্রবণতাকে বলে ধারকত্ব বা capacitance। এরা তখন পাত্রের মতন ইলেকট্রনগুলিকে এদের চারিধারে বন্দি করে ফেলে। ফলস্বরূপ, আমরা যত স্পিডেই বাইরে থেকে এই সুইচগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করিনা কেন, যেহেতু বন্দি ইলেকট্রনগুলি সহজে নড়াচড়া করতে পারেনা, সেহেতু কম্পিউটারের স্পিড-ও মিনিয়েচারাইজেশনের সঙ্গে কমতে শুরু করে। তাই এতদিন ইন্টেল-এর সহপ্রতিষ্ঠিতা গর্ডন মূরের ১৯৬৫ সালে করা বিখ্যাত ভবিষ্যতবাণী (Moore’s law) যে সেমিকন্ডাক্টর চিপে ট্রানজিস্টারের ঘনত্ব প্রতি দুইবছরে দ্বিগুণ হবে তা কমবেশি সত্যি বলে প্রতিপন্ন হলেও, ইলেকট্রনিক ট্রানজিস্টারের আয়তন আরও ছোটো করা ক্রমশই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে [১১]। এই সমস্যার সমাধানেই আজ আমরা আলোকবিজ্ঞানের একটি শাখা ফোটোনিক্স বা আলোক-কণা বিজ্ঞানের শরণাপন্ন।
আলোকবিজ্ঞানের বিস্তার
$$ইলেকট্রনিক্সের মতো কিন্তু আলোকবিজ্ঞানের ব্যবহারও সর্বত্র। হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত দুই দানবীয় যমজ কৃষ্ণ-গহ্বরের সংঘর্ষে ##উদ্ভূত অতিদুর্বল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের পরিমাপ থেকে [১২] পারমাণবিক ঘড়িতে অতিক্ষুদ্র অণু-পরমাণুর কম্পনের মাধ্যমে এক সেকেন্ডের কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ সময়ের নিখুঁত পরিমাপ করা পর্যন্ত আলোকবিজ্ঞানের বিস্তার [১৩, ১৪]। অবাক করা কান্ড হোলো, একদিকে যেমন উচ্চ উষ্ণতায় ধাতু গলিয়ে ঢালাইয়ের কাজ, তেমনি অন্যদিকে পরম শূন্য তাপমাত্রায় পৌঁছানো, দুই ক্ষেত্রেই লেসার ব্যবহৃত হয়। আবার সমুদ্রের নিচে পাতা মাইলের পর মাইল দীর্ঘ অপটিক্যাল ফাইবার (Optical Fiber) কেবল্-এর সৌজন্যে আজ আমাদের বাড়িতে দ্রুত-গতি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট (চিত্র ২) যা আমার আপনার নিত্য অনলাইন লেকচার শোনার, ইউটিউব ভিডিও অথবা নেটফ্লিক্সে রোমহর্ষক সিরিজ দেখার সঙ্গী [১৫, ১৬]। আলোক ঝলমলে পুজো প্যান্ডেলের LED লাইট, ছানি অপারেশনে ব্যবহৃত লেসার রশ্মি, বা আপনার টেবিলে অযত্নে লালিত একসময়ের খুব প্রিয় ধূলিমাখা সিডিটা, সবই আলোকবিজ্ঞানের দান। তবে আলোকবিজ্ঞান (অপটিক্যাল সায়েন্স) আর আলোক-কণা বিজ্ঞান (ফোটোনিক্স) পুরোপুরি এক নয়। সেটা বিস্তারিতভাবে জানতে গেলে আলোর গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। বস্তুত, ফোটোনিক্সকে আলোকবিজ্ঞানের একটি বিশেষ ধারা বলে চিহ্নিত করা চলে।
No comments