অনুঘটক, জৈব অনুঘটন ও নোবেল প্রাইজ - ২০২১ (প্রথম পর্ব)
অনুঘটক, জৈব অনুঘটন ও নোবেল প্রাইজ - ২০২১ (প্রথম পর্ব)
- অমলেশ রায়
SBPL, Goa
কিছু কিছু অণু আছে যাদের পারমাণবিক সজ্জা এক, অথচ দুটি ভিন্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। এই দুই ভিন্ন গঠনের অণুদ্বয় একে অপরের প্রতিবিম্ব (mirror image) কিন্তু একটি অণুকে কোনোভাবে ঘুরিয়ে অন্যটি তৈরি করা যায়না। এদের বলে কাইরাল (chiral) অণু। এক জোড়া কাইরাল অণুর রাসায়নিক এবং ভৌত ধর্ম এক হওয়ার ফলে এদের একটি মিশ্রণ থেকে আলাদা করা বেশ মুশকিলের কাজ। কিন্তু আমাদের শরীর এই দুটি গঠনের মধ্যে তফাৎ করতে পারে। এরকম দেখা গেছে যে, এর মধ্যে একটি গঠন ওষুধে থাকলে গর্ভবতী মহিলাদের কাজে লাগে কিন্তু অন্যটি আবার ভ্রূণের ত্রুটি ঘটাতে পারে। অথচ একটি সাধারণ বিক্রিয়ায় দুটি অণুই তৈরি হয় সমান পরিমাণে। তাই প্রয়োজনের তাগিদে যে কোনো একটি গঠনকে প্রাধান্য দিতে পারা জরুরি। সেটি করার কি কোন উপায় রয়েছে? উপায় তৈরি হয়েছে অপ্রতিসম অনুঘটনের (asymmetric catalysis) হাত ধরে। এই অনুঘটকগুলির বিশেষত্ত্ব কী? কীভাবে কাজ করে এরা? ২০২১-এর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল এই ধরণের “অপ্রতিসম জৈব অনুঘটন বিক্রিয়া” আবিষ্কারের জন্যেই।
২০২১-এ রসায়ন শাস্ত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বেঞ্জামিন লিস্ট (Benjamin List) এবং ডেভিড ম্যাকমিলান-কে (David W.C. MacMillan) নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। কোন কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ এই পুরস্কার? এক কথায় বললে, “অপ্রতিসম জৈব অনুঘটন বিক্রিয়ার উদ্ভাবন” (Development of asymmetric organocatalysis reaction)। এই একটি কথার মধ্যে অনেকগুলি অপরিচিত শব্দ আছে। তাই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক: অনুঘটন কি? জৈব অনুঘটন কী? “অপ্রতিসম” মানে কী? “অপ্রতিসম জৈব অনুঘটন” কী? এগুলি কোন কাজে লাগে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই লেখায় আমরা এক এক করে ব্যাপারগুলি বোঝার চেষ্টা করবো।
প্রকৃতির জটিল অণু গবেষণাগারে বানানো
একজন জৈব রসায়নবিদের চোখ দিয়ে দেখলে প্রকৃতি অসংখ্য অণুর সমষ্টি। তা সে মানুষ, গাছপালা, পশু-পাখি, চেয়ার-টেবিল, জল-মাটি-হাওয়া হোক, কিংবা ওষুধ। প্রাকৃতিক জিনিসগুলি আমাদের তৈরি করতে হয় না, প্রকৃতিই সেগুলি তৈরির দায়ভার নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু যেগুলি প্রকৃতিতে অপ্রতুল, বিশেষ করে জীবনদায়ী ওষুধ, সেগুলি কিন্তু আমাদেরকেই তৈরি করতে হয়। এই যেমন ধরো, পেনিসিলিন জৈব যৌগটি প্রথম পাওয়া যায় একটি ছত্রাকের শরীর থেকে। আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং-এর এই আবিষ্কার মানব সভ্যতার হাতে তুলে দেয় প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক। প্রকৃতি নিজে থেকেই কত সহজে পেনিসিলিনের মতো বিভিন্ন অণু তৈরি করে। কিন্তু প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল না থেকে যদি প্রয়োজন এবং চাহিদামত একইরকম গঠনের অণু আমরা তৈরি করতে চাই, সেটি কীভাবে করতে পারি?
অণুগুলিকে শনাক্ত করতে কিছু কৌশল (analytical technique) ব্যবহার করতে হয়। যেমন, Nuclear Magnetic Resonance (NMR), Infrared Spectroscopy (IR), Mass Spectrometry (MS), Crystallography এবং Optical rotation, ইত্যাদি।
- NMR : আমাদের দেহের ভিতরের ছবি যে MRI পদ্ধতি দিয়ে তোলা হয়, NMR অনেকখানি একই নীতি (principle) মেনে চলে। NMR দিয়ে কোনো অণুর মধ্যে হাইড্রোজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন, ইত্যাদি পরমাণুগুলির পারস্পরিক অবস্থান বোঝা যায়।
- IR : IR পদ্ধতি দিয়ে একটি অণুর মধ্যেকার পরমাণুগুলি একে অন্যের সাথে কি রকম বন্ধনে জুড়ে আছে, তা বোঝা যায়।
- Mass spectrometry : এই পদ্ধতি দিয়ে দিয়ে বোঝা যায় একটি অণুর আণবিক ওজন কত।
- Crystallography : এই পদ্ধতির সাহায্যে একটি কেলাসের (crystal) গঠন সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
- Optical rotation : এই পদ্ধতি দিয়ে অপ্রতিসম অণুগুলির ত্রিমাত্রিক গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এই নিয়ে “বিজ্ঞান”-এ আগেই আলোচনা করা হয়েছে, আগ্রহী পাঠক এখানে ক্লিক করে পড়তে পারো।
এইসব পদ্ধতি থেকে বোঝা যায় শুরুর ছোট ছোট অণুগুলি থেকে
অনুঘটক ও অনুঘটন (Catalyst and catalysis) কি?
ঘটক শব্দের সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। যে মানুষ একটি সম্পর্ক তৈরি করতে সাহায্য করে কিন্তু নিজে সম্পর্কে জড়ায় না, বরং তার উপস্থিতিতে সম্পর্কটি খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়, সে-ই ঘটক। অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তোমরা হয়তো কিছুটা বুঝতে পেরেছো। ব্যাস, তাহলে অনুঘটক ব্যাপারটিও তোমরা বুঝতে পারবে। একটি রাসায়নিক বিক্রিয়ায়, অর্থাৎ অণু-পরমাণু স্তরে, কিছু পদার্থ এই রকমের কাজ করে থাকে, এদেরই আমরা নাম দিয়েছি অনুঘটক।
আসলে একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া এমন একটি ঘটনা যেখানে এক বা একাধিক অণু এবং পরমাণুর মধ্যে বন্ধনের (bonds) ভাঙ্গা বা গড়া অথবা দুইই ঘটে। এই বন্ধন ভাঙ্গা বা গড়ার জন্য শক্তির প্রয়োজন হয়। তাই এইসব রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি শুরু করতে কখনও কখনও বাইরে থেকে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। সাধারণত কোন অনুঘটক একটি বিক্রিয়ায় উপস্থিত থাকলে বিক্রিয়ার সক্রিয়করণ শক্তি (activation energy), অর্থাৎ বিক্রিয়া শুরু করতে ন্যূনতম যত পরিমাণ শক্তি লাগে, সেটি কমিয়ে আনতে পারে। কিন্তু সেই অনুঘটক রাসায়নিক সাম্যাবস্থার কোনো পরিবর্তন করে না। অর্থাৎ, বিক্রিয়ার শেষে কি পড়ে থাকবে, কতটা থাকবে, তাতে অনুঘটকের থাকা না-থাকাতে কোনো তফাৎ হয়না। এটি কীভাবে কাজ করে, তা বুঝতে নিচের ছবিটি দেখো (চিত্র-২)। এখানে একটি বিক্রিয়ায় ‘ক’ এবং ‘খ’ মিলে ‘গ’ এবং ‘ঘ’ তৈরি করছে। ধরে নাও, “ঙ” এখানে অনুঘটকের কাজ করছে। “ঙ”-র অনুপস্থিতিতে বিক্রিয়া কাটা দাগের পথে যায় এবং “ঙ”-র উপস্থিতিতে যায় মোটা দাগের পথে।
দেখতেই পাচ্ছো, অনুঘটকের উপস্থিতিতে শক্তি লাগে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আর কম শক্তি লাগার ফলে বিক্রিয়ার গতি যায় বেড়ে। অর্থাৎ, অনুঘটক না থাকলে এই বিক্রিয়াই অনেক বেশী শক্তি ও সময় খরচে “ক + খ” থেকে “গ + ঘ” তৈরি করতো। ধরো, তুমি আগে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় একটি পাহাড়ের উপর দিয়ে আসতে, কাটা দাগের পথে। এখন একটি সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা হয়েছে, এবং তুমি সেই পথে (মোটা দাগ) বাড়ি আসো। অনুঘটক অনেকটা সুড়ঙ্গ পথে বাড়ি ফেরার মতো ঘটনা। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে শক্তি ও সময় বাঁচাতে অনুঘটকের ভূমিকা অনেকটাই [1]। অনুঘটকের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হওয়া এই বিক্রিয়াগুলিকেই বলা হয় অনুঘটন (catalysis)।
No comments